Thursday, 13 October 2011

Dedicated


পরিবর্তনের গল্প

     গনেশ বললো, “তোমাদের সেক্রেটারি কে?”
     লোকটি বললো, “যেই হোক, বৃষ্টি হলে পাঁচ টাকা বেশী দিতে হবে |”
     এইবার গনেশ রেগে গিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলে, “কেন? বৃষ্টি হলে কী তোমাদের খিদে বেশী পায়? আমার সময় নষ্ট করো না তো| এই নাও ১০ টাকা |”
    কথা কাটাকাটির আওয়াজ শুনে চারপাশ থেকে আরও কয়েকটা রিক্সাওয়ালা জড়ো হলো| তাদের মধ্যে বয়সে বড় একটা রিক্সাওয়ালা কাছে এসে বলে, “কী রে হরা, বাবুর সাথে ঝগড়া করছিস কেন?”
     হরা ওরফে হরেন বললো, “এই দেখো না পরানকাকা, এই লোকটা হসপিটাল থেকে মোড় পর্যন্ত এসে ১০ টাকা দেবে বলছে| এমনিতেই ভাড়া ১২ টাকা, আর বৃষ্টি পড়ছে বলে আরো ৩ টাকা বেশী চাইছি বলে বাবুর কী রাগ|”
     এইবার পরান তাকালো গনেশের দিকে, “কী আর করবেন বাবু| বুঝতেই পারছেন, বৃষ্টিতে এমনিতেই কেউ রিক্সা আনতে চায় না| ১৫ টাকা চাইছে দিয়েই দিন না|”
     “এই শুনুন, এমন কিছু বৃষ্টি পড়েনি| সেরকম বৃষ্টি পড়লে আপনারা রাস্তায় দাড়িয়ে ঝামেলা বাড়াতেন না| কী করবেন কী টাকা না দিলে? এই আমি চললাম|” , পরানের দিকে আঙ্গুল তুলে কথাগুলো বললো গনেশ|
     এইবার পরিস্থিতি একটু ভারী হয়ে গেল| রিক্সাওয়ালাদের ভিড় আরেকটু বেড়ে গেলো| তারই মাঝে ছোকরা গোছের একজন বলে উঠলো, “দেখুন, এখন আর ঐসব বলে কোনো কাজ হবে না| সব বদলে গেছে| পাড়ায় শান্তিতে থাকতে চাইলে সবাইকেই খুশি করতে হবে| এখন চুপচাপ পাঁচটা টাকা হরাকে দিয়ে দিন|”
     এই কথায় একটু ভয় পেলো গনেশ| পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে দিয়ে দিলো আর মনে মনে ভাবলো, “সত্যি সব কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে|”


     আজ থেকে ১০ বছর আগে নামী কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বিদেশে বড় কোম্পানিতে কাজ করতে চলে যায় গনেশ সরকার| তারপর থেকে ওখানেই মোটামুটি পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করে দেয় সে| দেশে খুব কম-ই আসতো গনেশ| প্রয়োজন পড়লে তবেই আসত, নয়তো নয়| তাই ওর পুরনো সমাজে যে কী পরিবর্তন এসেছে তা সম্বন্ধে কোনো ধারনাই ছিল না ওর| বিয়ে-থাওয়া করেনি গনেশ| বাবা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন| কলকাতার ঘরে আপনজন বলতে শুধু মা, ছোটভাই আর বৌদি|
     গনেশের মায়ের আচমকা খুব শরীর খারাপ| তাই খবর পেয়েই সুদুর আমেরিকা থেকে পাড়ি দিয়ে এসেছে নিজের শহরে| গতকাল সকালে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে গনেশ আর এর মধ্যে বুঝতে পেরে গেছে ওর সেই চেনা ১০ বছর আগের সমাজটা বদলে গেছে|

    
     ঘরে এসে মুখ হাত পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো গনেশ| ভাই আর বৌদি হাসপাতালে আছে, ঘরে এখন আছে শুধু কাজের মেয়ে মীনা| সেই কোন সকালে খেয়ে বেরিয়েছে গনেশ, মাঝখানে পেটে আর কিছু পড়েনি| তাই ঘরে ঢুকতেই ঢুকতেই মীনাকে গনেশ বলে দিয়েছে খাবার রেডি করতে|
     বাথরুম থেকেই বেরিয়েই মীনার গলার আওয়াজ পেলো গনেশ, “দাদাবাবু, খাবার গরম হয়ে গেছে| খেয়ে নিন|”
     “ঠিক আছে তুমি টেবিলে খাবার বেড়ে রাখো আমি আসছি|”- শোবার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো গনেশ|
     “খাবার তো আপনাকে নিজে নিয়ে নিতে হবে দাদাবাবু, আমাকে শুধু খাবার রান্ধার জন্য পয়সা দেয়| খাবার দেবার জন্য তো দেয় না!”- নামী একটা চ্যানেলে রোমাঞ্চকর সিরিয়াল হচ্ছিলো| টিভির পর্দা থেকে চোখ না তুলেই জবাব দিলো মীনা|
     “মানেটা কী? খাবারটা একটু দিয়ে দিতে গেলে কী তোমার বেশী পরিশ্রম হয়? একেই ঘরে তো এই অবস্থা, তার মাঝে তুমি বেশী ঝামেলা করো নাতো| খুজলে অনেক কাজের লোক পাওয়া যাবে| ভাত ছড়ালে কী আর কাকের অভাব হয়?”- চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে শুরু করলো গনেশ|
     “দেখুন দাদাবাবু, রাগ করবেন না| আমি কিন্তু সকাল থেকেই আজ আপনাদের ঘরেই আছি| অনেক্ষণ আগেই আমার চলে যাওয়ার কথা! আমি যে আজ বেশী সময় আছি না, এরকম কেউ থাকবে না|”- বলতে বলতে গজগজ করে ঘর থেকে বরিয়ে গেলো সে|
     “হুঃ, আজকালকার কাজের লোকদের মধ্যে মিনিমাম ভদ্রতাটুকুও নেই| ছোটবেলায় দেখতাম কাজের মাসিটাকে মা কত কথা শুনাতো, কীন্তু কাজের মাসি কিছু বলতো না|”- মনে মনে ভাবলো গনেশ|
     ডাইনিং টেবিলে বসে নিজেই খাবার নিয়ে খেয়ে নিলো গনেশ| তারপর ভিতর ঘরে গিয়ে লম্বা হয়ে গেলো, সারাদিনের পরিশ্রমের পর বিছানায় পিঠ পড়তেই ঘুম চলে এলো গনেশের|
 

     ঘুম ভাঙ্গলো সকাল সাড়ে সাতটায় ভাইয়ের ফোনে| ভাই আর বৌদি কয়েকদিনের জন্য হাসপাতালের সামনে একটা ঘর ভাড়া করে আছে| সেখান থেকেই ফোন করছে পরেশ, গনেশের ভাই|
     ফোনে গনেশ জানতে পারলো যে মায়ের অবস্থা একটু সিরিযাস হয়ে গেছে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে| ভাই গনেশকে বলেছে তাড়াতাড়ি টাকা নিয়ে হসপিটালে পৌছাতে, ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত কিনতে হবে|
     ভাইয়ের ফোন পেয়েই গনেশ ছুটলো হাসপাতালে| টাকাটা হাতে নিয়ে ব্লাড ব্যাঙ্কের লম্বা লাইনের পিছনে দাড়ালো ও|
     মিনিট দশেক পরেই একটি লোক এলো গনেশের কাছে| ততক্ষণে লাইনটা গনেশের পিছনেও অনেকটা বেড়ে গেছে, তবে গনেশ কিন্তু কাউন্টার থেকে একইরকম দুরেই রয়ে গেছে|
     “কী দাদা, লাইনের যা অবস্থা দেখছি, তাতে কাল ভোরের আগে রক্ত পাবেন না মনে হচ্ছে!কার চাই রক্ত? আপনার মা-এর না? ”-গনেশের কাঁধে হাট রেখে বিজ্ঞের মতো বললো লোকটা|
     “আপনি? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!”- খানিকটা থতমত খেয়ে গনেশ জিগেশ করলো|
     “ছ্যা, আমাকে এই হসপিটালের মোটামুটি সবাই চেনে| এই রক্ত নিতে লোকজনকে সাহায্য করি|”-কথাগুলো বলে অদ্ভুত ভঙ্গি করলো লোকটা|
     “মানে? বুঝলাম না!”-বেশ আগ্রহের সঙ্গে লোকটার কাছে একটু ঝুঁকে গেলো গনেশ|
     “মানেটা খুব সহজ| ওই কাউন্টারে রক্তের দাম ১০০ টাকা এক বোতল| আপনি আমাকে ২০০ দেবেন, আমি ২০ মিনিটের মধ্যে নিয়ে চলে আসবো| বুঝলেন?”-একটা বিজ্ঞের হাসি হেসে লোকটা তাকালো গনেশের দিকে|
     “হ্যা বুঝলাম, আর এও বুঝলাম যে আপনার মতো লোভী দালালদের জন্যই দেশটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে| জানেন এখানে কত গরিব লোক রক্তের জন্য আসে| আর আপনি তাদের ঘাড় ভেঙ্গে টাকা আদায় করেন? লজ্জা লাগে না আপনার?”-লোকটার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো গনেশ|
     “আরে দেখুন বেশ বড় বড় তো কথা বললেন, এই চিনের পাঁচিল পেরোতে যখন জান কয়লা হয়ে যাবে আর কাউন্টারে গিয়েও নানা ফ্যাংড়ার জন্য রক্ত পাবেন না, তখন বুঝবেন কে গরিব আর কে বড়লোক!”- হাত নাড়তে নাড়তে বলে চললো লোকটা|
     “এই আপনি যান তো, সকাল সকাল মাথা গরম করবেন না বলে দিছি| কেটে পড়ুন এখান থেকে তাড়াতাড়ি|”-বেশ রেগে গেলো এবার গনেশ|
     একটা মিচকে হাসি হেসে লোকটা যেনো ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেলো|
     যাই হোক, রক্ত নেবার লাইনটা ধীরে হলেও কাউন্টারের দিকে এগোচ্ছে| দেখে সামান্য স্বস্তি পেলো গনেশ| এরই মধ্যে আবে ভাইয়ের ফোন এলো গনেশের কাছে| মায়ের অবস্থার অবনতি হচ্ছে, রক্ত খুব তাড়াতাড়ি চাই| আবার এদিকে লাইনটাও মাঝখানে আবার থেমে গেছে| কাউন্টারের লোকটার সাথে কার একজনের প্রচন্ড তর্ক হচ্ছে| লাইনে দাড়িয়ে উসখুস করতে শুরু করলো গনেশ|
     এই সময় তার আবার মনে পরলো সেই লোকটার কথা-“সত্যি কী তাড়াতাড়ি রক্ত এনে দিতে পারবে লোকটা? দেখবো নাকি? কিন্তু লোকটাকে যেরকম মুখঝামটা দিয়েছি, তাতে কী দেবে রক্ত| দেখি একবার চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?”
     এরকম নানা সাত পাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত ওই লোকটাকেই খুঁজে বের করে অনেক হাতেপায়ে ধরে বেশী দাম দিয়ে রক্ত কিনতে হলো গনেশকে| পুরো পরিস্থিতির কথা ভেবে গনেশ বেশ অবাক হয়ে যাচ্ছিলো| কিছুতেই দশ বছর আগের সেই সহজ সরল সাদাসিধে পৃথিবীটার সাথে মিলিয়ে নিতে পারলো না সে| যত দেখছিলো ততই আশচর্য হয়ে যাচ্ছিলো|
     “যাকগে, মাকে তো ঠিক সময় রক্ত দেওয়া গেলো| এখন আর ওসব ভেবে লাভ কী?”-এই ভেবে পুরো ব্যাপারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলো গনেশ|


     গত রাত্রের ওই ঘটনার পর আজকে আর কাজের লোকটাকে বেশিক্ষণ থাকতে বলেনি গনেশ| হোটেলে যা হোক দুটো মুখে গুঁজে নিয়ে ঘরে ফিরতেই চক্ষু চড়কগাছ! ঘরের পুরো দরজা আগলে বড় একটা বটগাছের গুড়ি পড়ে আছে|
     “এটা আবার কোথেকে এলো?”-এই ভাবতে ভাবতে চারিদিক তাকাতেই গনেশ বুঝতে পারলো যে সামনের বড় বটগাছটা কাটা হয়েছে আর বড় গুড়িটা ফেলার বা নিয়ে যাওয়ার জায়গা না পেয়ে এখানেই ফেলে দিয়েছে|
     “মানে কিরকম অসভ্য হেছে আজকালকার লোক|”-মনে মনে প্রচন্ড খেপে গেলো গনেশ, “একে তো বিনা কারণে গাছ-টাছ কেটে ফেলছে তার ওপর অন্যের অসুবিধে করে সেগুলো এধার-ওধার ফেলে দিছে|”
     যাই হোক, কোনরকমে ওই বড় গুড়িটা সরিয়ে ঘরে ঢুকলো গনেশ|


     গনেশ পরেরদিন বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠলো| ভাইকে বলে রেখেছিলো যে বেশ কয়েকদিন ধরেই ভালো করে ঘুম হয়নি, সেইজন্য সকালে আর হাসপাতাল আসবে না-একেবারে দুপুরেই যাবে| সেইমতো ১১ টা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে সামনের রিন্টুর দোকান থেকে সামান্য কিছু খেয়ে হাসপাতালের দিকে পা বাড়ালো গনেশ|
     কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে সবকিছু দেখে শুনে মাথায় আগুন ধরে গেলো গনেশের| আজ সকাল থেকে মায়ের অবস্থার ভালোরকম অবনতি হয়েছে| ডাক্তাররা প্রথমে কিছুই বলতে চায়নি| পরে গনেশের ভাইয়ের অনেক পিড়াপিড়িতে সব কথা বেরিয়ে গেছে|
    কলকাতার এক নামী বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি ছিল গনেশের মা| কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওখানকার ডাক্তাররা গনেশের মায়ের ভুল চিকিত্সা করে যাচ্ছিলেন আর সেটা বুঝতে পারার পরেও গনেশের মাকে তাঁরা হাসপাতালে রেখে দিতে চাইছিলেন সুধু টাকার লোভে| এমনিতেই এখনি চল্লিশ হাজারের মতো খরচা হয়ে গেছে|
     এরপর হাসপাতালের অফিসঘরে গিয়ে গনেশ রীতিমত চিত্কার করতে শুরু করে দিলো| গনেশের ভাই আর ভাইয়ের স্ত্রী মিলে গনেশকে বোঝাতে চেষ্টা করলো যে যা হওয়ার তো হয়ে গেছে এখন মাকে অন্য কোনো হাসপাতালে ভর্তি করার কথা ভাবতে হবে|
     পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়ার পর ঠিক হলো যে মাকে এম্বুলেন্স-এ করে অন্য একটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে| যথরীতি এম্বুলেন্স-এর ব্যবস্থা করা হলো আর যথারীতি তাতেও অনেক ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হলো|
     এম্বুলেন্স-এ মায়ের সাথে যাচ্ছিলো গনেশ আর ওর ভাই| ভাইয়ের স্ত্রীও যেতে চেয়েছিলো কিন্তু ঘর ফাঁকা বলে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে|
     গাড়িতে যেতে যেতে গনেশ নিজের মনে ভাবতে থাকলো, নিজের দেশে আসার পর কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে মাত্র এই তিন দিনেই| আর কত অভিজ্ঞতা হবে তার কোনো ঠিক নেই| এদিকে মায়ের শরীর খারাপ, মন মেজাজও তেমন ভালো নেই|
     অনেকক্ষণ পর গনেশ ওর ভাইকে জিগেস করলো, “হ্যা রে ভাই আমাদের দেশটায় অনেক কিছু বদলে গেছে না?”
     ভাই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিগেস করলো, “কিরকম দাদা?”
     এরপর গনেশ ওর ভাইকে এক এক করে এদেশে আসার পর নিজের সব অভিজ্ঞতার কথা বললো| যেমনভাবে ঘটনাগুলো ঘটেছে ঠিক সেইভাবেই|
     এবারে মুখ খুললো ওর ভাই, “হ্যা রে ভাই সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে| এখন আর কোনো লোক-ই অপরের গোলাম হয়ে থকতে চায় না| সবাই নিজের প্রাপ্য আদায় করতে শিখে গেছে| নিজের ওপর অন্যায় হলে কেউ এখন মুখ বুজে বসে থাকে না| আর সবাই এখন সুযোগ সন্ধানী হয়ে গেছে| কী করে নিজের ফায়দা হয় সেই চিন্তাই তো লোকে এখন সবসময় করে| অপরের জন্য চিন্তা কেউ করে না রে দাদা|”
     “ঠিক তাই রে, কিন্তু আমাদের দেশটা তো এরকম ছিল না| সব তো বিদেশের কালচার| আধুনিক হতে গিয়ে লোকে তো বিদেশের খারাপ জিনিসগুলো আয়ত্ত করে নিয়েছে|”-বেশ দুঃখ করে বললো গনেশ|
     এরই মধ্যে আবার মায়ের অবস্থার অবনতি হতে লাগলো| বি.পি. কমে যেতে লাগলো হঠাত করে| কিছুক্ষণ পরে নাড়ি খুঁজে পাও গেলো না| গনেশ আর ওর ভাইয়ের মুখ ছোট হয়ে গেলো| তবুও শেষ আশা করে মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো| কিন্তু সেখানে ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করে দিলেন|
     ডুকরে কেঁদে উঠলো গনেশ| সেই নামী বেসরকারী হাসপাতালের নাম করে বলতে লাগলো, “ওরাই আমার মাকে মেরে দিলো, ছাড়বো না ওদের| খুব খারাপ লোক ওরা|”-পাগলের মতো বকতে লাগলো গনেশ| গনেশের ভাইয়ের প্রায় একই অবস্থা| আশেপাশের লোকজন শেষ পর্যন্ত ওদের শান্ত করলো|

   
      সেদিন ছিল গনেশের মায়ের শ্রাদ্ধ| স্বভবতই খুব ব্যস্ত ছিল গনেশ| কী একটা জিনিস কেনার জন্য বাইরে বেরিয়েছিল ও| হঠাত করেই সেই রিকসাওয়ালাটার সাথে দেখা যার সঙ্গে সেদিন কথা কাটাকাটি হয়েছিল গনেশের|
      হারা তো গনেশকে দেখেই সামনের একপাটি দাঁত দেখিয়ে জিগেস করে, “শুনলাম মাসিমা মারা গেলেন| কী হয়েছিল মাসিমার?”
     কোনরকম পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিলো গনেশ| কিন্তু থেমে গেলো পরের কথায়|
     হারা বলে উঠলো, “বাবু দেখছি এখনো আমার ওপর রাগ করে আছেন| যাই হোক, সেদিন ওই ভারী জিনিসটা দরজার সামনে থেকে সরাতে সমস্যা হয় নি তো কোনো? ওই বট গাছের বড় গুড়িটা?”
     পুরো থম মেরে গেলো গনেশ|
     চারিদিকে সত্যি পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে| 

Thursday, 18 August 2011

renaissance


                  নবজাগরণ
“কী গো? আজ কয়টার সময় আসবে? তাড়াতাড়ি আসবে না কালকের মতো দেরি করবে? দেরি করলে এখনি বলে দাও কাজের মাসি খাবারটা হট-পটে রেখে দেবে!!”-গতকাল রাতের তিক্ততার পর এই প্রথম সৌমিকের সাথে কথা বললো মীরা |
“আজো দেরি হবে!! আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না | তুমি আমনা খেয়েদেয়ে শু়যে পড়বে |ব্যাস | ঠিক আছে? আমার সমস্যার কথা তো কোনদিনই বুঝলে না আর বুঝবেও না | তোমার ভাগ্য ভালো যে স্টেট ব্যাঙ্কের একজন অফিসার তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে নাহলে কোথায় পড়ে থাকতে খেয়াল আছে?চলো আসছি |”-মীরার ইঅর্কার তাকে বেস কায়দা করে খেললো সৌমিক !!
মনটা বেশ খানিকটা ভেঙ্গে গেলো মীরার সৌমিকের এই কথাটা শুনে | মনে মনে ভাবলো-“কে  জানে কী হয়েছে সৌমিকের? যাকগে| আমাকে এখনো খাওয়াছে আর রাতে শুতে যাচ্ছে আমার সাথে এই যথেষ্ট|”

এক বছরের প্রেমের পর প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেল মীরা আর সৌমিকের প্রেম করে বিয়ে করা |কিন্তু অভিসার পর্বের সেই আনন্দ দুজনের কেউ পায় না |তারা এখনো নিঃসন্তান| দুজনেই চাকুরিজীবি | সৌমিক স্টেট ব্যাঙ্কের অফিসার আর মীরা একটা ছোটখাটো প্রাইভেট কোম্পানি-এর ওয়েব দিসায়নার | সভাবতই দুজনের জীবন-ই চরমতম ব্যস্ততার প্রতীক | শুধু হয়তো রাতের বেলায় বা সকাল বেলাতেই দুজন একসাথে থাকে তাও সেই সময়গুলো ভরে থাকে সন্দেহ, অভিমান, দোষারোপের মায়াজালের মধ্যে | শনি আর রবিবার দুজনেরই ছুটি থাকে ঠিকই কিন্তু আজ ওই আত্তিও-এর বাড়ি যাওয়া বা ওখানে পার্টি সেখানে তরীত এসব করেত করতে সেই দু দিনও পরস্পর পরস্পরকে কাছে পায় না | আর পাঁচটা শহুরে জীবনের মতই আর কী? এমন করেই তো ওদের জীবন কেটে যাচ্ছিলো | সব জীবন-ই তো কেটে যায় এইভাবেই | তাদেরটা আর ব্যতিক্রম কী!!
কিন্তু জীবনে নতুন মোড় শুধু সিনেমার পর্দাতেই দেখা যায় না, দেখা যায় বাস্তবের রঙ্গিন পর্দাতেও | আর তাই ঘটলো সৌমিক আর মীরা দুজনের জীবনেই |
_______________________________________________________________________
অফিস-এ কর্মী সংখ্যা বাড়ায় ক্রমেই কাজের চাপ কমছিলো সৌমিকের | তাছাড়া ব্যাঙ্কের বিভিন্ন জায়গায় শাখা খুলছে, তাই লোকজনের আনাগোনাও কম | তাই এখন সৌমিকের প্রচুর সময় অফিস-এ |
“নাঃ, আজ মীরা কে একটা ফোন করে চমকে দি | নিশ্চওই খুব অবাক হবে মীরা !! অনেকদিন পর হয়তো মীরা খুব খুশি হবে |
যেমন ভাবা তেমনি কাজ | ফটাফট মীরার নাম্বার ডায়াল করলো সৌমিক | ওপারে খুব সুন্দর কলার টিউনটা বেজে উঠতেই মনটাও যেনো নেচে উঠলো সৌমিকের !!! “বাহ্, কলার টিউনটা তো বেশ খাসা রেখেছে মীরা”, মনে মনে ভাবলো সৌমিক |
“হ্যালো কে সৌমিক? তোমাকে আমি কতবার বলবো অফিস টাইম-এ ফোন করো না য়্যান্ড য়াম বিসি নাউ | ক্যাচ উ ল্যাটার | বাই|”,সৌমিক কে একটাও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো মীরা |
মনে মনে বেশ রাগ হলো সৌমিকের | “কী এমন কাজ করে মীরা জ এত ব্যস্ত?আমার সাথে দু মিনিট –ও কথা বলতে পারলো না ও?!! আশ্চর্য!! দূর, আমি জ কী করি এখন |” এই ভেবে নিজের ল্যাপটপ খুলে নেট কানেক্ট করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পরলো সৌমিক| কখনো কখনো এই নেট মানুষের একাকিত্ব দূর করে দেয়|  
-------------------------------------------------------------
মীরা কিন্তু মোটেও নিজের অফিসের কাজে ব্যস্ত নয় | অফিস-এ ইন্টারনেট-এর সামনে মীরা খুঁজে পেয়েছে এক অদ্ভুত নতুন জীবনকে | যার পোশাকী নাম ফেসবুক | কত চেনা অচেনা লোকজনএর সাথে আলাপ হয় এতে | মাত্র ৫ দিন হলো নতুন একাউন্ট খুলেছে মীরা | এর মধেই শ খানেক বন্ধু পাতিয়ে নিয়েছে মীরা, শুধু এ দেশেরই নয় বিদেশের-ও আছে | তবে তাদের মধ্যে মীরার সবচেয়ে ভালো লাগে প্রিযব্রতকে | প্রিয়ব্রত উইপ্রো-এর জেনারাল মানাজের | তার-ও বাড়ি কলকাতাতেই | মীরের ভবানীপুর থেকে সামান্য দুরে আলিপুরদুয়ারে | প্রিযব্রতর কথা বলার ধরণ টা কমন যেনো | অনেকটা বিয়ের আগের সৌমিকের মতো | সেই কেটে কেটে কথা বলা-মানে মীরা তো বুঝতে পারে না সৌমিক কেটে কেটে কথা বলে না কী করে, আসলে ফেসবুকে চ্যাট করার সময় খুব আসতে আসতে টাইপ করে বলে প্রিযব্রতকে হয়তো ঐরকম লাগে | তবে সৌমিকের মতই কথায় কথায় সর্রী বলা-যদিও সৌমিক এখন আর মীরা কে সরি বলে না | মীরাকেই বলতে হয় |
তবে প্রিযব্রতর বয়সটা এখনো জানতে পারেনি মীরা | “বয়স যতই হোক, প্রিযব্রতর সঙ্গে কথা বলতে তো আমার বেশ ভালই লাগে, তাছাড়া আমার তেমন কাজ থাকে না, সময় কাটবে কী করে?!”-ফেসবুক থেকে লগ আউট করতে করতে ভাবছিলো মীরা | “আবার ঘরে গিয়েই কাজের পর কাজ, ঘর গোছানো আর কী,কিন্তু ঐটা করতেই তো দম বেরিয়ে যায়| মা-এর কাছে তো কিছু শিখলাম না| তারপর আবার সৌমিক কতায় আসবে তার ঠিক নেই | আসার সময় জেগে থাকলেও মুস্কিল না জেগে থাকলেও মুস্কিল| জীবনটা ক্রমেই দুর্বিসহ হয়ে উঠছে|”-এসব ভাবতে ভাবতে অফিসের গেট থেকে বেরিয়ে অটোতে বসলো মীরা|
আজ সোমবার |কাল মীরা আর সৌমিক দুজনেই ঘরে ছিল| কিন্তু কী একটা ব্যাপার নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি চরমে পৌছে যায়| আর তাই ওরা দুজনে দুটো আলাদা ঘরে সু়ে পরেছিলো রাত্রেবেলায়| রাতের খাবার সৌমিক কথায় খেয়েছিলো সেই খবরটা নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি মীরা | কেনই বা নেবে? সৌমিক-ও তো জিজ্ঞেস করে নি!
যাই হোক, সবেমাত্র মীরার অফিসে ফার্স্ট হাফ শেষ হয়েছে| “আজ প্রিযব্রতর সঙ্গে কথা বলতে কেন জানি না খুব ভালো লাগছিল | আজ আবার আমার প্রিয়াঙ্কা নামটাকে ছোট করে প্রিয়া বলেছে| হি হি,ও তো আর জানে না যে আমার আসল নামটা ফেসবুকে নেই| সে যাই হোক| নামে কী আর এসে যায়! সৌমিক-ও তো আমাকে বিয়ের আগে শুধু মি বলে ডাকতো| আগে কত ভালো ছিল সৌমিক| বিয়ের আগে এমন করতো যেনো বর্ হতে পারলেই বর্তে যায়| আর বিয়ের পর? সেই সৌমিক হারিয়ে গেল| মা ঠিকই বলেছিলো-কারোর সাথে প্রেম করা আর ঘর করা এক নয়| তখন মায়ের কথা শুনিনি, তাই এখন পস্তাতে হচ্ছে| সে যাক গে, অনেকদিন পর আমার সাথে কেউ এরকম ভাবে ভালো ব্যবহার করছে! আর যায় হোক সৌমিকের থেকে তো অনেক ভালো! কাল সৌমিক আমার সাথে যেভাবে ব্যবহার করলো, ভ্বাতেও পারা যায় না!”-অফিস ক্যান্টিনে পরোটা আর আলুর দম খেতে খেতে এসবি ভাবছিলো মীরা|
-------------------------------------------------------------
এভাবেই মীরার হৃদয় যেনো ধীরে ধীরে সৌমিক থেকে প্রিযব্রততে পরিবর্তিত হতে লাগলো| প্রিযব্রতর মধ্যে মীরা যেনো খুঁজে পেলো তার হারানো পুরনো সৌমিক কে | পুনরায় আবিষ্কার করতে পারলো নিজের আশা, ভরসা, ভালোবাসাকে প্রিযব্রতর মাধ্যমে|মীরার পক্ষে কেকদিন পরেই পরিস্থিতি এমনি দাড়ালো যে ঘরের কাজ কোনমতে শেষ করে অফিস গিয়ে ফএস্বুকের সামনে বসতে পারলেই হলো| আর আজকাল তো সৌমিক-ও বলে দিয়েছে অর্ অফিস কাজের চাপ বেড়ে গিয়েছে| তাই ও এখন ১০ তার জায়গায় সকাল ৮ টা তেই বেরিয়ে যায়! তাই আরও সুবিধা হলো মীরার | তবে সৌমিকের অফিস-এ কাজের চাপ হঠাত বেড়ে গেছে কেন টা জানতে ইচ্ছেও হয়নি মীরার| হবেই বা কেন? অপরের অসুবিধা যদি নিজের সুবিধার কারণ হে দাড়ায় তাহলে অসুবিধার কারণ জানতে কার-ই বা ইচ্ছে করে? আসলে জ কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেই বোঝাপড়া শব্দটা খুব গুরুত্বপূর্ণ | আর সেই জিনিস্ টারই বড় অভাব মীরা আর সৌমিকের মধ্যে| তাই হয়তো মীরা আর চায় না সৌমিককে, প্রিযব্রতর মনোভাব,কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি আকৃষ্ট করে মীরাকে| না হোক মুখোমুখি কথা ওদের মধ্যে, কিন্তু প্রিযব্রতর সাথে কথা বলেই এক অনাবিল আনন্দে ডুবে যায় মীরা|
-------------------------------------------------------------
আজ সৌমিক অফিসে যায় নি| কাল বন্ধুর জন্মদিনে একগাদা খেয়েদেয়ে পেট খারাপ করেছে সৌমিকের| সৌমিক মীরাকে কত রিকুয়েস্ট করলো ঘরে থাকার জন্য, কিন্তু মীরা শুনলো না| মীরা বললো ওর নাকি অফিসে অনেক কাজ আছে| কিন্তু আসল কারণ অবস্যই প্রিয়ব্রত| ওর সাথে একবারমাত্র কথা বলার জন্য সারাদিন ব্যাকুল হয়ে থাকে মীরা| অফিসে গিয়েই একমাত্র প্রিযব্রতর সাথে কথা বলার সুযোগ পায় মীরা, আর এই সুযোগ ও কিছুতেই ছাড়তে চায় না| হোক না স্বামীর শরীর খারাপ, কিন্তু সৌমিকের চেয়ে প্রিযব্রতর গুরুত্ব অনেক বেসি এখন মীরার কাছে| আর তাছাড়া বিয়ের পর প্রিয়ব্রত-ও তো মীরাকে কতবার উপেক্ষা করেছে মীরাকে, অফিস কাজের দোহাই দিয়েছে, তাহলে আজ যদি মীরা একই জিনিস করে সৌমিকের সাথে তাহলে নিশ্চই সেটা দোষের কিছু নয়|
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অফিস-এ পৌছালো মীরা, আর পৌছেই নেট খুলে ফেসবুক| এখনো অনলাইন হয়নি প্রিয়ব্রত| ঘড়ির দিকে তাকালো মীরা| “ওহ এই তো সবেমাত্র সাড়ে আটটা বাজে| এখনো অফিসে আসেনি হয়তো প্রিয়ব্রত| যাক গে আমি আমার কাজগুলো চটপট সেরে ফেলি, তাহলে সারা দিনটাই ওর সাথে গল্প করবো| কাজ তো বেশী নেই,তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে|”-এই ভেবে অফিসের কাজ করতে শুরু করলো মীরা| কাজের ফাঁকে ফাঁকে একবার করে চ্যাট লিস্ট-টা দেখে নিছিলো ও| এরই মধ্যে অফিসের ম্যানেজার ডাক দিলো মীরাকে| বেশ বিরক্ত হলো ও| কিন্তু কিই বা করা যায়,অফিসের ম্যানেজার বলে কথা-যেতেই হবে| কিন্তু মম্যানেজার প্রায় দু ঘন্টা আটকে রেখে দিলো মীরাকে, আর ওদিকে প্রিযব্রতর জন্য মন ছটফট করছে মীরার-“না জানি কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে ও,এই ম্যানেজারতাও হয়েছে ভান্টের” ভাবতে ভাবতে নিজের ফেসবুক একাউন্টে লগ ইন করলো মীরা| কিন্তু না,এখনো প্রিয়ব্রত অনলাইন হয়নি| বেশ অবাক হে গেল মীরা,এমনটা তো কোনদিনও হয়না!! প্রিযব্রতর একাউন্ট চেক করলো মীরা| না সেখানেও প্রিযব্রতর অনলাইন হওয়ার চিহ্ন নেই| সত্যি সত্যি অনলাইন হয়নি প্রিয়ব্রত|
এইবার একটু মন খারাপ করতে শুরু করলো মীরার| অর্ সাথে কথা বলার জন্য মীরা প্রায় সারাদিন ধরে উসখুস করে, কিন্তু প্রিযব্রতই আজ অনলাইন হলো না| “হয়তো ও আজ অফিসে আসেনি বা অফিসে কোনো জরুরী কাজে আটকে পরেছে!!”-এইসব ভেবে নিজেকে স্বান্ত্বনা দিলো মীরা| ওর-ও অফিসের টিফিন টাইম হে গেছে| তাই উঠে পড়তে হলো মীরাকে| ক্যান্টিনে এসে আজ মনের দুঃখে প্রায় কিছুই খেতে পারলো না | টিফিন শেষ হতেই এক দৌড়এ অফিসে নিজের চেম্বারএ গিয়ে কম্পিউটার অন করে ফেসবুক খুললো মীরা| নাঃ এখনো অনলাইন হয়নি প্রিয়ব্রত!! এবার বেশ ভেঙ্গে পরলো মীরা| একা একা চেম্বারে বসে প্রিযব্রতকে মিস করতে লাগলো সে| আর ওর ছোট্ট অফিসে সহকর্মীর সংখ্যা কম, যারা আছে তাদের সাথেও মীরার সাথে মনোমালিন্য আছে মীরার| কী করবে ভাবতে লাগলো মীরা| একবার ভাবলো-“সৌমিককে ফোন করে দেখি কী করছে ও|” পরক্ষণেই ভাবলো-“দূর ওটা তো আরো বোরিং,ফোন করলেই জিগ্যেস করবে কখন বাড়ি ফিরবো| টার চেয়ে প্রিযব্রতর জন্য ওয়েট করি|”
ঘড়ির কাঁটা যখন প্রায় ৩ টে ছুলো তখন মীরার কাছে দেবদুতের আবির্ভূত হলো প্রিয়ব্রত, মানে ফেসবুকের চ্যাটে এলো ও| হৃদয় যেনো আনন্দে ফেটে পড়তে চাইলো মীরার| ও যা ভেবেছিলো ঠিক তাই-প্রিয়ব্রত কী একটা জরুরি কাজে আটকা পড়ে গেছিলো|
একথা সেকথার পর প্রিয়ব্রত হঠাত করে মীরাকে মানে প্রিয়াকে জিগেস করলো ও বিবাহিত কিনা| মীরা জানতো প্রিয়ব্রত এখন বিয়ে করেনি, তাই ও নিজের সম্পর্কে মিথ্যা কথাই বলে দিলো| ও বললো যে অনেক সম্বন্ধ এসেছিল, কিন্তু একটাও পছন্দ হয়নি| আর তাছাড়া যাদেরকে ও চেনেইনা তাদের সাথে কিভাবে সারা জীবন কিভাবে ঘর করবে?
তারপর একথা সেকথার পর প্রিয়ব্রত ফস করে নিজের মনের ইচ্ছাটা টাইপ করে ফেললো-“প্রিয়া তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তোমাকে দেখতে সুন্দর| তুমি যদি কিছু মনে না করো তাহলে তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারি আমি?”
মীরা এইবার বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল| মনে মনে ভাবলো-“প্রিয়ব্রত, তোমাকে দেখতে আমারও ইচ্ছে হয়!! তুমি আমার ভালোবাসকে ফিরিয়ে দিয়েছে, নতুন করে ভালোবাসতে শিখিয়েছে| কিন্তু আমি যে বিবাহিত, তাছাড়া তুমি ফেসবুকে যাকে প্রিয়া বলে চেনো সে তো আর প্রিয়া নয় অন্য কেউ|” কিন্তু প্রিযব্রতকে অফিসের কাজের চাপের কারণ দেখালো মীরা| কিছুতেই মানতে চাইলো না প্রিয়ব্রত, বললো অর্ সাথে প্রিয়াকে দেখা করতেই হবে!
“আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে প্রিয় তুমি তোমার ফোন নাম্বার দিয়ে দাও, আমি তোমাকে পরে জানাবো|”-মীরা ওরফে প্রিয়া বললো|
কিন্তু ফোন নাম্বার দিতে নারাজ হলো সে| বললো যে-“ঠিক আছে, ফোন নাম্বার নেওয়ার দরকার নেই| তুমি দিন ঠিক করো আর কাল আমাকে অবস্যই জানিও| আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই প্রিয়া| সত্যি”| এই বলে অফলাইন হে গেল প্রিয়ব্রত| ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মীরা দেখলো ওর-ও যাওয়ার সময় হয়ে গেছে|
-------------------------------------------------------------
রাস্তায় নেমে একটা অটো দেকে ওতে উঠে বসলো মীরা আর ভাবতে শুরু করলো প্রিযব্রতর কথা গুল-“ও আমার সাথে দেখা করতে চায় কিন্তু কেন? অর্ কী আমার মতই অনুভূতি হচ্ছে? আর অর্ সাথে দেখা করবই কিভাবে? আমাকে যদি অর্ সাথে কেউ দেখে নেয় তাহলে খুব বাজে পরিস্থিতি হবে!! নাঃ কালকেও কিছু একটা বলে কাটিয়ে দেবো ওকে| তাছাড়া আমার আর কিছু করার নেই| পারলে কেকদিন পর প্রিযব্রতর সাথে কন্টাক্ট-ও বন্ধ করে দেবো| নাহলে হয়তো অন্যরকম পরিস্থিতি হতে পারে! আমি যা পেয়েছি তাই নিযেই খুসি থাকতে হবে আমাকে!” মনটা বেশ ভারী হয়ে উঠলো মীরার|
-------------------------------------------------------------
এই পৃথিবীতে মানুষ অনেক কিছুই চায়| কিন্তু পায় না| না পাওয়ার কারণ বিভিন্নরকম| কোনটা আর্থিক কোনটা রাজনৈতিক আর কোনটা বা সামাজিক| কিন্তু সমাজ্বধ্হ জীব মানুসের কাছে সবসময় প্রাধান্য পায় তার সমাজ তার পরিবার তার আত্বীয়-স্বজন| সেই একই কারণে মীরাকে ত্যাগ করতে হবে প্রিযব্রতর সাথে দেখা করার বাসনা, ভুলে যেতে হবে ওকে| এই একটা সমাজ-ই মানুষকে হয়তো পূর্ণ স্বাধীনতা দেয় না| তাকে নিজের অনেক ইচ্ছা কে অপ্রকাশিতই রাখতে হয় আজীবন| মীরার ক্ষেত্রেও কী তাই ঘটবে?
------------------------------------------------------------
ঘরে এসে সৌমিকের সাথে ভালো করে কথা বললো না মীরা| কিন্তু সৌমিককে কমন যেনো বেশ খুশি খুশি দেখালো| মীরা শুধু একবার জিগ্যেস করলো সৌমিক ঠিকঠাক খেয়েছে কিনা| সৌমিক তার উত্তরে শুধু একবার আলতোভাবে হ্যান বললো| ব্যাস ঐটুকুই| তারপর সারা সন্ধ্যা দুজনেই যেনো কিসের মধ্যে ডুবে গেল|
রাত্রে খাবার টেবিলে বসে মীরা হঠাত প্রিযব্রতকে জিগেস করলো যে সারাদিন ও কী কী করেছে| এই কথা শুনে প্রিয়ব্রত বেশ খেঁকিয়ে উঠলো-“আমি সারাদিন কী করলাম না করলাম তাতে তোমার কী মীরা? আমি কখনো জিগেস করি, তুমি অফিস গিয়ে সারাদিন কী করো? আমি ক্যাফে তে গিয়েছিলাম একবার| অফিসের কেকটা জরুরি মেল পাঠানোর ছিল, তাই| ব্যাস, আর বাকি সময়টা মড়ার মতো পরে ছিলাম| তোমাকে একবার কল করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, কিন্তু তুমি তো খুব ব্যস্ত থাকো, তাই করলাম না আর|”-মীরাকে ক্ষত দেওয়ার সুরে বললো সৌমিক|
“শোনো সৌমিক. তুমিও তো অফিসএ থাকলে আমি জিগেস করি না তুমি কী করেছে সারাদিন ধরে| আজ তুমি ঘরে ছিলে তাই জিগ্যেস করলাম| আর আমি যদি সত্যি ব্যস্ত থাকি তাহলে কী তোমাকে বলবো যে আমি ব্যস্ত নই? তুমি তো খুব বলো যে আমি নাকি তোমার অসুবিধার কথা বুঝতে পারি না| আচ্ছা, এটা কোনদিন ভেবে দেখেছো যে তুমি আমার অসুবিধার কথা বুঝতে পারো কিনা?”-কথাগুলো বেশ খারাপভাবে সৌমিককে বললো মীরা|
এরপর আর দুজনের মধ্যে কথা হলো না সেই রাত্রির মতো| সেই রাত্রেও দুজনে শুলো আলাদা ঘরে| সারা রাত মীরা ভাবতে লাগলো প্রিয়ব্রত আর সৌমিকের কথা| সৌমিক-ও হয়ত ওকে আর চায় না, এদিকে প্রিযব্রতর সাথেও কথা বলা ছেরে দিতে হবে| মনটা সত্যি ভেঙ্গে পরলো মীরার| চোখ বেয়ে জল নেমে এলো মীরার| এই প্রথম ও বুঝতে পারলো যে জীবনটা সত্যি কত কঠিন| কিন্তু প্রিয়ব্রত কত ভালো,ঠিক যেনো পুরনো সৌমিক| এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরলো মীরা|
-------------------------------------------------------------
অটোতে যেতে যেতে বেশ টেনশন হচ্ছে মীরার| আরেকবার মাথায় হাত দিয়ে দেখে নিলো চুলটা ঠিক বাঁধা হয়েছে কীনা| বসেই বসেই শাড়ির অঞ্চলটা ঠিক করে নিলো একবার, পার্স থেক আয়না বের করে দেখে নিলো লিপ স্টিক টা বেশী লাগানো হয়ে যায়নি তো! ওটা বেশী লাগালে আবার মীরাকে দেখতে ভালো লাগে না| যতই হোক প্রিয়ব্রত ওকে দেখতে সুন্দর বলেছে!
হ্যান, আজ মীরা প্রিযব্রত্র সাথে দেখা করতে যাচ্ছে! কিছুতেই মানলো না সে, বললো যে দেখা করতেই হবে| কিন্তু দুজনে মিলে প্লান টাও বেশ ভালই বানিয়েছে! প্রিয়ব্রত বলেছে জ ও একটা রেড শার্ট আর ব্লাক প্যান্ট পরে আসবে| আর মীরা নিজের ড্রেসের বর্ণনা দিয়েছে| ঠিক হয়েছে দুজনে দেখা করবে ভিক্টোরিয়ায় ঠিক বেলা ২ তোর সময়|
সেই অনুযায়ী মীরা অর্ অফিসের ফার্স্ট হাফ শেষ হতেই বেরিয়ে পরেছে, একটাই ব্যাপারে খটকা লাগছে ওর-প্রিয়ব্রত কেন কিছুতেই অর্ মোবইল নাম্বার দিলো না| যাক গে, প্রিয়ব্রত-ও তো অর্ কাছ থেকে নাম্বার চায় নি| ও হয়তো একটু বেশিই ভেবে ফেলছে| আজ অনেকদিন পর নতুন কিছু পাওয়ার, নতুন কিছু দেখার আশায় মনটা দুলে দুলে উঠছে মীরার| মনে বেশ খুশি খুশি ভাব, ঠোটে এক চিলতে হাসি|
এইরকম ঘোরের মধ্যে থাকতে থাকতেই অটো চলে এলো ভিক্টোরিয়ার সামনে| অতর ভাড়া মিটিয়ে ধীরে ধীরে মীরা এগোলো টিকিট কাউন্টারের সামনে| একবার দেখে নিলো ঘড়িটা-১ টা ৪০,মানে এখনো মিনিট ২০ সময় আছে| চারিদিকে তাকিয়ে নিলো মীরা-না কোনো লাল জামা কালো প্যান্ট এখনো আসেনি|মীরা আরেকবার ওদের কোড ওয়ার্ডটা আউরে নিলো-“নবজাগরণ”| এই বুদ্ধিটা প্রিযব্রতর-ওই বলেছে যে লাল জামা কালো প্যান্ট পরে তো অনেকেই থাকতে পারে| তাই এই শব্দটা বললেই ওরা পরস্পরকে চিনতে পারবে|
টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলো মীরা| আজ ভিচ্তরিয়াকে অন্যরকম লাগলো মীরার, যেনো ওদের দুজনের অস্চর্জ মিলনের জন্যই বানানো হেছে এই স্মৃতিসৌধ| এধার ওধার মীরা দেখতে পেলো কত প্রেমিক-প্রেমিকা জুটি| এইখানেই তো ও কতবার এসেছে সৌমিকের সাথে| কিন্তু সৌমিক এখন অতীত ওর কাছে| মীরার মন এখন শুধু প্রিযব্রততে আছন্ন| অনেকদিন পর মীরা যেনো অর্ হারানো যৌবন ফিরে পেলো| অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো ওর|
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে মীরা চমকে উঠলো| ২:১০! চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো, না, কোনো লাল জামা কালো প্যান্ট নেই! তাহলে কী প্রযব্রত আসবে না? না প্রিয়ার মতো প্রিয়ব্রত-ও মিথ্যা| “না না এটা হতে পারে না! সবেমাত্র তো দশ মিনিট হয়েছে, আরেকটু দেখি না|”-মীরা ভাবলো| মীরা ঠিক করে নিয়েয়েছে যে প্রিযব্রতকে সব সত্যি কথা বলে দেবে! মানে ও বিবাহিত, ওর নাম প্রিয়াঙ্কা নয়-এইসব| আর এর জন্য ও প্রিযব্রতর কাছে ক্ষমাও চেয়ে নেবে ঠিক করেছে! কিন্তু ক্রমে আধ ঘন্টা পেরিয়ে গেল| কোনো চিহ্ন নেই প্রিযব্রতর| “ওর মনে আছে তো ওকে কী পরে আসতে হবে!”-বুকের ভেতর যেনো পাথর চেপে বসলো মীরার|
দুরের একটা বট গাছের ফাঁকে কী একটা দেখে যেনো মীরার মন আনন্দে নেচে উঠলো-“আরে ওই তো ওই তো লাল জামা কালো প্যান্ট| কিন্তু মুখ টা দেখতে পারছি না! আমি কাছে যাবো? হ্যান যাই নিয়ে আমাদের শব্দটা বলে ওকে চমকে দি| আমি নিশিত ওই প্রিয়ব্রত!” যেমন ভাবা তেমনি কাজ| গুটি গুটি পায়ে মীরা এগিয়ে গেল সেই লাল জামা কালো প্যান্টের কাছে|
এমন সময় মীরা ক্ষনিকের জন্য দেখতে পেলো ওর প্রিযব্রতর মুখ| তা দেখে ওর মাথায় আকাশ যেনো ভেঙ্গে পরলো| সবকিছু গুলিয়ে যেতে লাগলো| আড়ালে সরে গিয়ে এক জায়গায় বসে পরলো মীরা| মাথা ঘুরতে লাগলো মীরার, চোখে যেনো অন্ধকার দেখতে শুরু করলো| প্রচন্ড ঘামতে থাকলো মীরা! এক এক করে সব পরিষ্কার হতে থাকলো মীরার সামনে-প্রিযব্রতকে সৌমিকের মতো মনে হওয়া, প্রিযব্রতর ফোন নাম্বার না দেওয়া, সৌমিকের ক্যাফে যাওয়া, আগে আগে অফিস যাওয়া, সেদিন প্রিযব্রতর দেরি করে অনলাইন হওয়া-সবকিছু|
 মীরার প্রিয়ব্রত আর কেউই নই-ওরই স্বামী সৌমিক!!
-------------------------------------------------------------
মীরার মতো সৌমিক-ও নিজের একঘেয়েমি জীবন কাটানোর উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিলো ফেচ্বুককে| তার-ও ভালো লেগেছিলো প্রিয়াঙ্কাকে, সেও নিজের ভালোবাসকে পুনরায় আবিষ্কার করেছিলো প্রিয়াঙ্কার মধ্যে|
দুটো একই মানুষ, কিন্তু আলাদা সত্তা| সৌমিক আর মীরার মধ্যে নবজাগরণ হইছিলো, কিন্তু সে নবজাগরণ প্রকৃত নয়, মায়া|
---------------------------সমাপ্ত----------------------------